পূর্ববাংলার লােকসংগীত গ্রন্থে প্রাণময় পূর্ববাংলার ভাবসম্পদে সমৃদ্ধ রচনাগুলিতে লালন ফকির,হাছন রজা, কাঙাল আতপ, জালাল উদ্দিন, শেখ আবদুল্লা, মৃণালকান্তি দাস, পঞ্চানন দাস, সুখময় দাস, রাধারমণ, দীন শরৎ প্রমুখের নাম ভণিতায় উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া অনেকের নাম অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। এই সংগ্রহ-গ্রন্থ সেইসব জ্ঞাত এবং অজ্ঞাতপরিচয় লােককবিদের কবিত্বের স্বীকৃতি বহন করবে।
ষােলােটি শ্রেণীতে বিভক্ত সাতচল্লিশটি গানের সংযােজন করে পূর্ববাংলার বৈচিত্র্যময় জনজীবন ও পারিপার্শ্বিকতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি রূপচিত্র পরিস্ফুটনের প্রচেষ্টা যুক্ত হয়েছে গ্রন্থটিতে।উল্লিখিত ষােলােটি শ্রেণী এবং পৃথকভাবে প্রত্যেকটি গান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা করে নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা আরােপ করার চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধার কথা ভেবে সহজ পদ্ধতির স্বরলিপির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।স্বরলিপিকরণে সস্নেহ সহযােগিতা করেছেন শ্রীযুক্ত কার্তিকচন্দ্র ঘােষ (পটলবাবু)।গ্রন্থটির অঙ্গসজ্জা, পারিপাট্য-সাধন ও প্রুফ দেখার দুরূহ কাজে ঐকান্তিক প্রয়াস যুক্ত হয়েছে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের শ্রীযুক্ত গগন দের।পূর্ববাংলার সীমা দূরপ্রসারিত এবং সুদীর্ঘ বলে তার লােকসংগীতে কথা ও সুরের ক্ষেত্রে যে অভিনবত্ব এবং বৈচিত্র্য দেখা যায় কোনাে একটি গ্রন্থে তার পরিপূর্ণ প্রতিফলন সম্ভব নয় বলেই মনে হয়। তা ছাড়া এই সংগীত যেমন পরম্পরাগত ও শ্রুতিনির্ভর তেমনি আধুনিক স্বরলিপি পদ্ধতির সাহায্যে এর যথাযথ রূপটিকে রক্ষা করাও কঠিন। ভাটিয়ালি গান কোনো প্রকার তাল বা বাদ্যযন্ত্র ব্যতিরেকেই গীত হয়। সুতরাং মাত্রাবৃত্ত স্বরলিপির দ্বারা ভাটিয়ালির পরিচয় দেওয়া সংবাদপত্রের ফটোর সাহায্যে
পদ্মমেঘনার রূপ দেখানাের মত। লোকসংগীত সংগ্রহ করাও বিশেষ শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক অনুশীলন,রসজ্ঞতা, অধিকার ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। একই ধরণের শত শত গানের নির্বিচার সংগ্রহ গবেষণা সংগ্রহশালার পক্ষে প্রয়ােজনীয় কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক শিক্ষাপদ্ধতির জন্য নির্বাচন অপরিহার্য।পূর্ববঙ্গের লােকসংগীতকে কেবল কথা বা সুর অথবা বিষয়বস্তুর প্রেরণা কিংবা গানের উপলক্ষ, বা কোনো একটি নির্দিষ্ট আদর্শ দিয়ে বিশ্লেষণ করা যায় না। প্রভাতী গান গাইবার সময়কাল দিয়ে নির্দেশিত কিন্তু।গোষ্ঠ বা বিচ্ছেদ বিষয়াতি গান। অথচ সর্বত্রই রাধাকৃষ্ণ বা কৃষ্ণপ্রসঙ্গ গীতবস্তুর মধ্যে প্রাধান্য লাভ করেছে। সারি বা ভাটিয়ালি বিশেষভাবে সুরপ্রণালী হলেও ভাটিয়ালি গান প্রেম ও বিষন্ন বিরহের।ক্রন্দনে উদাস আর সারি গান লীলায়িত বাতাসে তরঙ্গকল্লোলিত নদীবক্ষে আনন্দময় নৌকাচালনারসঙ্গেই বিশেষভাবে জড়িত। অথচ এই ভাটিয়ালি সুরকে অনায়াসে নারীর জলভরার গানেও ব্যবহার করা হয়েছে, নৌকাবিলাসের গানেও সেই সুর শুনতে পাই, বাউল গুরুভজন বা তত্ত্বমূলক গানেও সেই
একই সুরের পুনরাবৃত্তি। প্রসঙ্গত স্মর্তব্য যে, পূর্ববাংলা লােকসংগীতে বাউল কোনাে বিশেষ এক ধরণের সুরকে বােঝায় না। বাউল একটি তত্ত্বাদর্শের নাম, একটি সাধন ভজনের প্রণালী আর সেই প্রণালীর উদাসীন নির্লিপ্ত বৈরাগ্য যে-কোনাে সুর অবলম্বনে প্রচারিত হলেই তাকে বাউল গান বলা যেতে পারে।