একদিন তার খ্যাতির ডঙ্কা বেজেছিল বাংলা দেশে। তখনাে গ্রামােফোন নামের বস্তুটা বাজারে নতুন। ওর ঘুরন্ত চাকতির উপর ভর করেই তার নামটা পৌছেছিল লােকের কাছে। শুরু হয়েছিল রেকড সঙ্গীতে কে-মল্লিকের যুগ। বলা যায়, গানের এই নতুন যন্ত্রযুগের প্রথম পর্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান গায়ক তিনি।তারপর এসেছে আরাে নতুন নতুন শক্তিমান গায়ক। তাদের জয়যাত্রায় পুরাতন পড়েছে পিছিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মের সঙ্গে তাল রেখে। সুরের রেশের মতই আজ মিলিয়ে এসেছে লােকের মনে রেকড সঙ্গীতের এই সম্রাটের নাম। অথচ একদিন তার নাম ছিল একটা নয়, দুটো নয়, তিনটে ! কে-মল্লিকের পাশাপাশি মুন্সী মহম্মদ কাসেম এবং পণ্ডিত শঙ্কর মিশ্র। কেন একজন গায়ককে তিনটে নামের কবচ ধারণ করে বাঁচতে হয়েছিল সে কথা ক’জন জানে ? গানের দুনিয়ার এই বুড়াে বাদশার সঙ্গেই আমার একদিন হঠাৎ দেখা। একী ভগ্ন
দশা ! দেখলাম তার ভাঙ্গা শরীর। শুনলাম তার ভাঙ্গা গলা। মাথায় শনের মত পাকা চুল, গালে মাংসের চেয়ে অস্তির প্রাধান্য, মেরুদণ্ড গিয়েছে বেঁকে। শুধু চোখ দুটো দেখে মনে হয়, এককালে এর অনেক কিছুই ছিল। এখনাে চোখের
তারায় ক্ষণে ক্ষণে রহস্য উঠছে ঘনিয়ে, আর কি একটা নিবিড় শান্তির ছায়া পড়ছে তাতে। দেখলেই মনে হয় এই মানুষটির মনে আর যাই হােক কোন ক্ষোভ নেই।এর রাজদরবার যখন জমজমাট, তখন হয় আমি জন্মাইনি, নয় নিতান্তই শিশু। শুধু কানে লেগে আছে সেই ছােটবেলায় শােনা মিষ্টি সুরের ‘বাগিচায়।
বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’! তখন অনেকের মুখেই শুনতাম,‘আমারে চোখ ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গাে দরদী। আর একটা গানের ।কয়েকটা লাইনও মনে আছে :
লােহারি বাঁধনে বেঁধেছে সংসার,
দাসখত লিখে নিয়েছে হায় !
আমার খেটে খেটে খেটে জন্ম গেল কেটে
তথাপি এ ছার খাটা না ফুরায়!
আলস্য অসুখ রােদ-বৃষ্টি নাই
কাধেতে জোয়াল না আছে কামাই
চক্ষু জলে পপারে, মুছি এক করে।
অন্য করে বােঝ তুলি মাথায় !
বাংলা গানে খেটে খাওয়া মানুষের দীর্ঘশ্বাস আর কোথায় এমন ধ্বনিত হতে শুনেছি সহসা মনে আসছে না। কিন্তু আজকের তেহাত্তর বছয়ের বৃদ্ধের কণ্ঠেই সেদিনের সঙ্গীত সুরধুনি বয়ে চলেছিল, এর পরিচয় না জানলে কে তা আজ
বিশ্বাস করতে পারত!হঠাৎ মনে হল, এর জীবনেই হয়ত এমন কত কাহিনী থাকতে পারে যা এমনি করেই আজ অসম্ভব বলে বােধ হবে। কে জানে হয়ত এই লােলচর্মের আড়ালেই
লুকিয়ে আছে কত রস, কত রােমাঞ্চ ! সে সব সব শুনতে চাইলে কেমন হয় ?শুকনাে ফুলকে কি শুধানো যায় না—তুমি একদিন ফুটেছিলে কী আনন্দে, বল না? পুরনাে প্রাসাদের কাছে গিয়ে কি কথনাে ইচ্ছে করে না প্রশ্ন করি—বলে
দাও না তােমাদের কক্ষে কক্ষে একদিন যৌবনের মত্ততা দিনে রাত্রে কি স্বপ্নজাল বুনে চলত ! জঙ্গলাকীর্ণ দীঘির ভাঙ্গাঘাটের ধারে দৈবাৎ গিয়ে হাজির হলে কি তার অতীতের অজস্র স্নানার্থীদের বিচিত্র কাহিনী জানতে মন চায় না কখনো!এরা কেউই কথা বলতে পারে না। তবু তাদেরই মনের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে কত সাহিত্য কত কাব্য রচিত হল। ভাষাহীনের কথা কইতে গেলেই উচ্ছসিত হয় কল্পনা, প্রসারিত হয় প্রকাশের সীমা। কিন্তু যে মানুষ জীবন্ত সে
নিজের কথা নিজেই বলতে পারে। যার নামধাম বাড়ীঘর আত্মীয়স্বজন সবই স্পষ্ট,তার কাহিনীতে কল্পনার পাখা মেলবার আকাশ সীমাবদ্ধ। সেখানে রঙের সঙ্গে।রঙ, ঘটনার সঙ্গে ঘটনা, গােপনতার সঙ্গে প্রকাশ্যের অবাধ বিস্তারের সুযােগ সামান্য। সেখানে পান থেকে চুণ খসলেও বিপদ। তাই প্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার
জন্য মানুষ আবিষ্কার করেছে তার কথা সাহিত্য।
তবু জীবনীর চাহিদা কেন? একটা ক্ষেত্রে কাল্পনিক সাহিত্যের চেয়ে জীবনীর জিৎ।