Description
এই বইয়ের শুরুতে পণ্ডিত রবিশঙ্কর লিখছেন: –যেটাকে আমরা নন্দনতত্ত্ব বলি—এসথেটিকস এবং মনন, চিন্তা—এই দুটোর যােগাযােগ খুব জোরালাে যে গানে, আমি তাকেই একটা সার্থক গান বলব। আমি সে ধরনের গানই ভালবাসি। এই দুইয়ের মেশামিশির সঙ্গে সঙ্গে আরও যেটা চাই তা হল একটা আধ্যাত্মিক শক্তি…গানের—একটা পিরিচুয়্যাল অ্যাটমস ফিয়ার বলতে পার। এ তিনটের সমন্বয় ঘটাতে পারলে তুমি একটা অত্যন্ত উচু পর্যায়ের গান পাবে। পূর্ণ আনন্দ পাওয়া যায় যে গানে।অবশ্য আমাদের ধ্রুপদী গান শুনে যথাযথ আনন্দ পেতে গেলে তােমাকে অনেকআগের থেকে মনটাকে তৈরি করতে হবে। এ কথা আগেও কয়েকবার বলেছি যে,একজনের গান বা বাজনা শুনতে গিয়ে তুমি যদি অন্য কারাে ঢঙের জিনিস শুনতে চাও তবে সেটা ভুল হবে। তােমার নিজের পক্ষেই ক্ষতিকর হবে।কারণ, তুমি যথেষ্ট আনন্দ পাবে না সেভাবে গান শুনে।এখন আমার নিজের কিছু, প্রিয় গায়কদের কথায় ফিরে যাচ্ছি। যেমন ধরাে, ফৈয়াজ খাঁ সাহেব। ওঁর গান আমার চিরদিনই ভাল লেগেছে। হিন্দুস্থান রেকর্ডের ডিস্কে ঐ তিন সাড়ে-তিন মিনিটের রেকর্ড কিন্তু তার ভেতরই ওঁর
গানের বিশেষত্বটকু ধরা পড়েছে। ওঁর একটা বলিষ্ঠ অ্যাপ্রােচ ছিল, রাগকে খুব পুরুষালী ঢঙে আক্রমণ করতেন। রাগের জানটাকে খুব চমৎকার ধরতে পারতেন। উপরন্তু বলিষ্ঠ ঢঙে গাইতেন বলে ওঁর গানের পরিবেষণায় একটা
দারণ এফেক্ট ছিল। ওঁর নিজের ব্যক্তিত্বটাই ফুটে উঠত সেখানে। বিশেষ করে ওঁর ‘নম তুম’ অংশটা আমার খুব ভাল লাগত। আলাপচারির ভাগটা,
ওঁর আমাদের বীণকারদের মতনও নয়, আবার রবাবীদের ঢঙেও নয় ; দুটো মিলিয়ে-মিশিয়ে একটা অত্যন্ত নিজস্ব চমৎকার জিনিস। আর তারপর যে জোড় উনি গাইতেন, আহা! আমরা জোড় বলি বাজনার অঙ্গ থেকে নেওয়া
যেটা ; ওঁর কাছে সেটা ছিল নম তুম। আলাপের পরের পর্যায় যেটা, অর্থাৎ লয়বদ্ধ আলাপ বলে উনি যেটা গাইতেন—এত ভাল গাইতেন এসব! তা ছাড়া।যন্ত্রের যেসব জিনিস, ঝালার অঙ্গ, যা উনি গলায় করতেন—আমার সত্যিই খুব ভাল লাগত। গলায় ওরকম আমি আর কারাে শুনিনি। অবশ্য ওঁর নকল করে অনেকে গান, কিন্তু ওঁর এবং তাঁদের সে গানের মধ্যে কোয়ালিটির দুস্তর ফারাক থেকে গেছে। তারপর ধরাে ওঁর ধামার। উনি যে ধামারটা গাইতেন সেটা খুব বিলম্বিত লয়ে গাইতেন না। বেশ একট, বাড়িয়েই গাইতেন। তবে এত সুন্দর ওঁর হিসেবটা ছিল, এত সুন্দর মুখে আসতেন, এবং বাণীটাকে নিয়ে সেই দুগুণ, চৌগুণ করে কাজ সাজাতেন—চমৎকার! খাঁ সাহেব বড় রাগগুলো খুব ভাল গাইতেন; তবে যে-কোনও রাগেইহােক, ওর অ্যাপ্রােচটা একেবারে অন্যরকম ছিল। ওঁর সুর লাগাবার ঢঙ ছিল খাড়া খাড়া। হয়তাে এর পেছনে একটা কারণ আছে ; সেটা হচ্ছে হারমােনিয়মের প্রভাব। আমার
এক প্রিয় শিষ্য শামীম আহমেদের বাবা গলাম রসল ফৈয়াজ, খাঁ সাহেবের ,গানের সাথে হারমোনিয়মের সংগত করতেন। সর্বদাই দেখেছি, ওঁর সংগত খাঁ সাহেবকে দারুণ ইন্সপায়ার করত। একটা সুরের থেকে অন্য একটায় মিশে মিড় টেনে এগোনো—সেটা ওঁর কম ছিল না। একটু, জোর দিয়ে গাইতেন এবং খুব ডিরেক্ট সুর লাগাতেন। সেই কারণে, সত্যি বলতে কি, personally ওর দরবারী আমার প্রাণকে অতখানি যেন হত না। তার কারণ-দরবারীতে
যে গান্ধারটাকে আমরা এত বড় মনে করি, সেই মাখােমাখাে অতি কোমল গান্ধার,সেই আন্দোলিতভাবে লাগানাে, সেটা উনি দেখতাম সােজা, খাড়া খাড়া লাগাতেন। হয়তাে অতি কোমল গান্ধারই লাগাতেন; কিন্তু যেরকম সােজা সােজা লাগাতেন যে, শুনতে আমার কি জানি, অন্যরকম ঠেকত। দরবারী রাগটা ধরাে।
গানের ভেতর আমার ভাল লেগেছে সােয়াই গন্ধর্বের, সুরেশবাবু, মানে,ওয়াহিদ খাঁ সাহেবে, তারপর আমির খাঁর। দরবারী গঙ্গুবাঈকেও কয়েকবার বেশ ভাল গাইতে শুনেছি। যন্ত্রে আমার, সত্যি বলতে, আমাদের ঘর অর্থাৎ
বীণকার সেনীয়া ঘরাণা ছাড়া দরবারী পুরােপুরি কারােই ভাল লাগেনি। তার কারণ—দরবারীর যে বিশেষত্ব, যেটা শুনে শুনে, সাধনা করে করে আমরা ধারণা করেছি—অর্থং গান্ধারের.যে অমােঘ প্রয়ােগ, তা কোথায় পাচ্ছি?
Be the first to review “রাগ অনুরাগ - রবি শংকর”
You must be logged in to post a comment.