Description
উনিশশাে সাতষট্টির মে মাসে নকশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থান ভারতীয় রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মােড়, যা রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অনেককিছুর মধ্যে এর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রথাগতভাবে চলে আসা নাগরিক আধিপত্য ভেঙে সমাজের প্রান্তদেশ থেকেও নেতৃত্বের উত্থান। ‘রাজনীতির এক জীবন’ সে-রকমই এক নেতার স্মৃতিকথা যা নকশালবাড়ির পাশাপাশি ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতির এক নতুন, নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়ন।
লেখক লিখেছেন,১৯৭২ সালের আগস্ট মাস থেকে ১৯৭৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত (মাঝে কিছুদিন প্রেসিডেন্সি জেল ও তিহাড় সেন্ট্রাল জেলে থাকা বাদ দিলে) পাঁচ বছর মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলই ছিল আমার ঠিকানা। আমাকে ৩২-সেলে পাঠানাে হল। এটা ছিল একটা দোতলা বাড়ি। নীচের তলায় ১৬টা এবং দোতলায় ১৬টা সেল ছিল। সেলগুলাের সামনে লম্বা টানা বারান্দা, ঢােকার দরজায় গরাদওলা লােহার গেট। বাইরে থেকে সেলের ভেতরটা দেখা যেত। আমি যেদিন ৩২-সেলে ঢুকলাম, তখন সেখানে ছিলেন মেঘনাদ, প্রদীপ ব্যানার্জি,দীপু বােস, প্রদীপ সিংহ ঠাকুর, বাণী বারিক, রণবীর সমাদ্দার, সব্যসাচী চক্রবর্তী, বেণু দলাই, সুরেন সিংহ, শঙ্কর মিত্র, অশােক মাইতি ও আরও কয়েকজন। ইতিমধ্যে জেলের কমরেডদের মধ্যেও রাজনৈতিক লাইন অনুযায়ী বিভাজন ঘটে গেছিল। মেদিনীপুর জেলে বেশির ভাগ বন্দি সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অশােক মাইতি ও শঙ্কর মিত্র সহ কিছু কমরেড চারু মজুমদারের লাইনের পক্ষে ছিলেন। ৩২ সেলেও কমরেডদের মধ্যে দুটি ভাগ ছিল। সেই বিভাজন এতই তীব্র হয়েছিল যে কখনও কখনও তাদের মধ্যে কথাবার্তাও হত না, কিংবা একপক্ষ খবরের কাগজ কিনলে অপর পক্ষকে তা পড়তে দিত না।সেলগুলােতে সন্ধ্যা ছ’টার সময় তালা পড়ত।সেটা ছিল ‘লক-আপ’-এর সময়। ভাের সাড়ে পাঁচটায় আবার গুনতি হয়ে তালা খােলা হত। দুপুরবেলা শুধু বারান্দার গেটে তালা পড়ত। সেলগুলাে খােলাই থাকত। এক-একটা সেলে
একজন বা তিনজন বন্দিকে লক-আপ করা হত, কখনওই দু’জন নয়। জেলে যেহেতু সমকামিতা খুব বেশি ছিল, তাই ব্রিটিশ আমল থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। ওয়ার্ডে একসঙ্গে বহু বন্দি লক-আপ হত। কিন্তু সেখানেও সমকামিতা
ছিল। বিশেষত যাবজ্জীবন বা দীর্ঘমেয়াদে কারারুদ্ধ আসামীরা অল্পবয়সি বিচারাধীন বন্দিদের কিছু সুবিধা দিয়ে ‘ছােকরা’ হিসাবে ব্যবহার করত। ছােকরা’জেলের পরিভাষায় একটা চালু কথা। কখনও কখনও কোনও ‘ছােকরা’-র দখল নিয়ে দীর্ঘমেয়াদিদের মধ্যে ঝগড়াঝাটিও হত। নকশাল ওয়ার্ডে বা ৩২ সেলে
সমকামিতার সমস্যা না থাকলেও একজন বা তিনজন লক-আপ হওয়ার ব্যবস্থা চালু ছিল।৩২ সেলে প্রতিটি সেল দিনে দু’বার সার্চ হত। একবার সকাল বেলা লক-আপ খােলার সময়, আর একবার সন্ধ্যাবেলা লক-আপের সময়। সেই সার্চ করত মেট ও পাহারা-রা। দীর্ঘমেয়াদি আসামিরা কিছুদিন জেলে থাকার পর একটা বেল্ট পেত। এদের বলা হয় মেট। আসল কথাটা হলো ‘কনভিক্ট ওভারসিয়ার’।
Be the first to review “রাজনীতির এক জীবন -সন্তোষ রাণা”
You must be logged in to post a comment.