Description
আঠারাে শতকের শেষে জিপসিরা স্পেনের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত ছিল। সমাজের চোখে তাদের স্থান ছিল সস্তা পানশালায়, যেখানে চলত মদ্যপের কাধে ঝোলানো গিটারের সঙ্গে নিম্নরুচির গান। লােরকা লক্ষ্য করেছিলেন যে এতৎসত্ত্বেও জিপসি সমাজ ‘সিগীরিয়া’র শুদ্ধধারাটি টিকিয়ে রেখেছিল। লােরকা ও তার সমমনস্কেরা বুঝেছিলেন যে কিছু অবক্ষয়িত গানকে মানুষ আন্দালুস লােকগীতি বলে ভুল করছে, তাতে প্রকৃত লােকগানের আবেদন ক্ষীণ হয়ে আসছে। এই ধ্বংসােন্মুখ ঐতিহ্যকে রক্ষা করা সামাজিক কর্তব্য। ১৯২২-এ মানুএল দে-কাইয়া ফ্লামেনকো লোকগীতি জনপ্রিয় করতে গ্রানাদায় এক বিরাট পুরাতনী সঙ্গীত উৎসব (Concurso de cante jondo)-র আয়ােজন করেন। সে দিনের শ্রেষ্ঠ গায়ক ও গিটার বাদকেরা এ উৎসবে অংশ নিয়েছিলেন। এই উপলক্ষ্যে লােরকা নানা জনসভায় আন্দালুস লােকগীতির গুরুত্ব কথা প্রচার করেন ১৯২১-এ লেখেন poema de cante jondo’, পুরাতনী সঙ্গীতের কাব্য। এই সময় থেকেই লােরকা ও দে-ফাইয়ার প্রচেষ্টায় ফ্লামেংকো নবরূপে বিশ্বে পরিচিতি পেতে শুরু করে। ১৯৩৫-এ জীবন সীমান্তে সঙ্গীত ও কবিতার যুগলবন্দি তাকে ছেড়ে যায়নি। সোনা সুরে সুর মেলানাে আন্দালুস গানের দিগদর্শন করেছেন তিনি, এমন কি পারসিক ধারার গজল ‘gacela’ আর ‘qasida’ তেও।ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য স্পেনের ডিটেক্টর জেনরল ফ্রানসিসকো ফ্রাংকো নির্দেশে লোরকাকে গােপনে হত্যা করা হয় ১৯৩৬ সালে, এখন পর্যন্ত অজানা কোথায় তার দেহাবশেষ। স্পেনীয় ভাষা-চর্চা ও সাহিত্যে আলােচনার উদ্দেশ্যে অধুনা প্রতিষ্ঠিত লােস ইস্পানােফিলােস (Los Hispanofilos) সমিতির পক্ষ থেকে লােরকার স্মৃতিতে নিবেদিত এই বইটি প্রকাশ করা গেল।স্পেন এবং দক্ষিণ আমেরিকার উনিশটি দেশের সাহিত্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযােগ বাংলা-ভাষা পাঠকবর্গ সম্মান পেয়েছেন। তার কারণ স্পেনীয় ভাষায় শিক্ষার সুযােগ এ দেশে কয়েক বৎসর আগেও নিতান্ত বিরল ছিল, ফলে মূল স্পেনীয় ভাষা থেকে অনুবাদ প্রায় হয়নি বললেই চলে। বর্তমান গ্রন্থটি স্পেনীয় ভাষায় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কয়েকজন সাহিত্য অনুরাগীর প্রচেষ্টা। মূল ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে এবং যে সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিমন্ডলের গর্ভে সেই সাহিত্য নিহিত তার সঙ্গে পরিচয় অনুবাদ কর্মে প্রয়ােজন। স্পেনীয় ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ এবং তাই থেকে বাংলায় পুনরনুবাদ যথেষ্ট নয়। এই নীতি মনে রেখে এই প্রবন্ধ-সংকলনের পরিকল্পনা।সাহিত্য সমালোচক হয়ে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে লােরকা অথবা আর কোনও সাহিত্যকার সম্বন্ধে লিখতে পারেন, কিন্তু অনুবাদের ক্ষেত্রে আপােষ করা মূল লেখকের প্রতি অবিচার। অনুবাদ তত্ত্বে যাকে অভীষ্ট ভাষা (target language) বলে, অর্থাৎ বাংলা ভাষা, তার নিজস্বতা স্বীকার করে, মূলানুগতা নিতান্ত প্রয়ােজন। বর্তমান গ্রন্থে অনুবাদ এবং সাহিত্য সমালােচনার ক্ষেত্রে সেটাই উদ্দিষ্ট। ফেদেরিকো গার্সিয়া লােরকার প্রতিভা ছিল নানা বিচিত্র পথগামী। তার সাহিত্য কৃতির মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় রােমান্টিক ঐতিহ্যের অনুসারী কবিতা, লোকগীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত গীতি বাক্য, তার জন্মভূমি গ্রামীণ আন্দালুসিয়া থেকে নিউইয়র্ক নগরী পর্যন্ত সমাজের মানুষের কথা, শহুরে অভিজাত দের জন্য মঞ্চস্থ নাটক, ফ্যাসিবাদ বিরোধী রাজনৈতিক বার্তাবহ লোকনাট্য,খেয়ালের পরীক্ষামূলক পুতুল নাটক, তার শিক্ষক-মহলের ওতের্গা ই গাসেট (Ortega y Gasset)বা মিগেল দে উনামুনোর (Miguel Unamuno)অনুপ্রেরণায় দার্শনিক নিবন্ধ, এবং সর্বোপরি তাঁর নিজস্ব মানসিক স্বাতন্ত্র উদ্ভূত চিন্তার প্রবাহ কবিতায়, নাটকে ও প্রবন্ধ রচনায়।এই বিভিন্ন ক্ষেত্রে লোরকার প্রতিভার প্রকাশ কেমন ভাবে ঘটেছিল? কয়েকটি প্রবন্ধে এই বইটিতে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
Be the first to review “ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ভাবনায় ও অনুবাদে -সম্পাদনা:মালবিকা ভট্টাচার্য”
You must be logged in to post a comment.